সংসারের সবচেয়ে ছোট যে সদস্য থাকে সে থাকে সব সময়ই একটু বেশিই আদরের। আর যদি বড় ভাই বোনের সাথে তার বয়সের পার্থক্য থাকে একটু বেশি, তাহলে সে হয়ে যায় পরিবারের সবার কাছে খেলনা পুতুলের মত। পাঁচ ভাই বোনের ভেতর সবচেয়ে ছোট বলেই সেও ছিল একটু বেশিই আদরের। খেলনা পুতুলের মত। বাবা- মা গর্ব ভরে বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে তার নাম রেখেছিলেন রাসেল।
জন্মের পর থেকেই সে দেখেছিল তার আব্বা মাঝে মাঝে কোথায় যেনো হারিয়ে যান। বেশ কিছুদিন আর বাসায় ফেরেন না। সে ভেবে নিয়েছিল এই মানুষটি বুঝি অন্য আরেকটা বাড়ীতে থাকেন। পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যের কোলে চড়ে সে সেখানে যেত বাবার সাথে দেখা করতে। কিন্তু যতক্ষণ না তার বাবাকে দেখত মুখটা থাকত গম্ভীর। মোটেও শিশু সুলভ সরল হাসিখুশি নয়। কিন্তু বাবাকে দেখা মাত্র আলো ঝলমল হয়ে উঠত তার মুখ। আব্বা, আব্বা করে ডেকে উঠত। আবার যখন ফিরে আসার সময় হতো, গম্ভীর মুখে পেছনে ঘুরে হাতটা নাড়তে থাকত। সে হয়ত কারাগারকেই ভেবে নিয়েছিল ওটাই তার আব্বার ঠিকানা।
বাবা তাদের সাথে থাকছেন না কেনো ! বারবার কোথায় হারিয়ে যান! বোঝার বয়স তার হয়নি তখনও। শত্রু কাকে বলে! কে শত্রু! কেনো বা শত্রু কিছুই বুঝে উঠতে পারত না সে বয়সে। বাবাকে দেশের মানুষ জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু আখ্যা দিয়েছে। এ গভীর সম্মানসূচক আখ্যার মর্মার্থ জানত না সে।
দেশ স্বাধীন হলো। কাকে বলে স্বাধীনতা? শুধু ভেবেছিল এবার বুঝি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আব্বা থাকবেন তাদের সাথে। তখন সবেমাত্র ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুল ইউনিফর্ম পরে সবার মত করেই স্কুলে যায় আসে। বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করে সময় কাটায়। অবসরে কবুতরের সাথে খেলায় মাতে। শিশু রাসেল ভাবতেও পারে নি, খুব শীঘ্রি এক ভয়ঙ্কর রাতে সে চিরতরে শহীদ হয়ে যাবে। দূরন্ত শৈশবের মাঠ থেকে তুলে তাকে ছূড়ে দেয়া হবে গহীন গহ্বরে।
যখন সারা বাড়ীতে চলছে পৈশাচিক তান্ডব। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল এই শিশুটিরও। একজন কর্মচারীর কাছে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিল, "ওরা কি আমাকেও মেরে ফেলবে ?" কর্মচারীটি টেবিলের নীচে লুকিয়ে রেখেছিল তাকে,মুখ চেপে ধরে রেখেছিল যেনো কেউ ওর আওয়াজ না শোনে। কিন্তু তার মত একটি ফুটফুটে শিশুকে হত্যা করতেও নরপিশাচদের হাত কাঁপে নি। "মায়ের কাছে যাবো" বলে চিৎকার করতে থাকা শিশুটিকে তুলে এনে মায়ের বুকের ওপর আছড়ে ফেলে তার ছোট্ট বুকটা বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
তার আর পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠা হয় নি। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয় নি। বুবুরা জার্মানিতে যাওয়ার সময় খুব যেতে চেয়েছিল রাসেল। অনেক কেঁদেছিল সে। বুবুদের সাথে আর কখনও দেখা হয় নি। শখের কবুতরগুলোকে আর দানা দেয়া হয় নি কোনোদিন। আজও তার বুবু তাকে খুঁজে বেড়ায় এদেশের সবখানে তন্নতন্ন করে। পৃথিবীতে রাসেলের সময় ছিল মাত্র দশ বছর কয়েক মাস। আজ যে হয়ে উঠত পরিপূর্ণ প্রবীণ।
Post a Comment